Header Ads

"আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস"।


"আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস"।

আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। ১৯৫২ সালের আজকের এই দিনেই সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র রক্তক্ষয়ী ঘটনা, যা মুখের ভাষার জন্য করা হয়। সেদিন মায়ের ভাষার জন্যই প্রাণ দেন সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ আরো অনেক। 

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অনেক লম্বা। যা ইতিহাস থেকে ছোট্ট আকারে আমি তুলে ধরছিঃ- 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারববর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামের একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এটি আবার পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান এই দুই ভাগে বিভক্ত। পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় ১০০০ মাইল দূরত্বের ব্যবধান। ধর্মের ভিত্তিতেই মূলত এটাকে এক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের শাসনের নামে শোষণ করতে থাকে। তারা প্রথমেই আঘাত হানে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুখের ভাষায়। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার মতামত দেন৷ তখন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ আরো অনেকে এর প্রতিবাদ করেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। এটিই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠন। এই সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নাকি উর্দু" প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।

তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপদানের জন্য ৪৭-এর অক্টোবরে গঠিত হয় "রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ"। এ সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে। কিন্তু, এসব কিছুকে উপেক্ষা করে ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি করার পক্ষে কথা বলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগণ। 
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুতে কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলা কংগ্রেস পার্টির সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলাকেও অধিবেশনের অন্যতম ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু, মুসলিম লীগের সদস্যরা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। এ ঘটনায় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে।  ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। 

১১ই মার্চ " রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের" আহ্বানে ধর্মঘট পালিত হয়। সেই ধর্মঘটের দিনে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" শ্লোগানের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে।  সেখান থেকে পুলিশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেককেই গ্রেফতার করে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩-১৫ মার্চ আবার ধর্মঘট পালিত হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আন্দোলনকারীদের সাথে বসে- গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আইন পরিষদে উত্থাপন বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। 

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রমনার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য দেন। দুটি বক্তব্যেই তিনি বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, "উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা "। উপস্থিত ছাত্ররা এর প্রতিবাদে 'না না" ধ্বনি দিয়ে উঠে। এসময় সারা পূর্ব পাকিস্তানেই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে৷ আবার ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এসে বক্তৃতাকালে আবার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন৷ তখনো ছাত্ররা 'না না" ধ্বনি বলে প্রতিবাদ করে উঠে। 

১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষা আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতিবাদ করেন। এর বিরুদ্ধেই শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশে বলা হয়, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।দেশজুড়ে প।প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ চলতে থাকে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।  এর প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা ও সর্বাত্মক রূপ লাভ করে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি সভা ও ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান করে৷ ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সর্বদলীয় সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে "সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ" গঠিত হয়। এ সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসময় হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ করেন৷ সরকারি এ ঘোষণা পাওয়া মাত্রই ঢাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে  ছাত্ররা কিছুতেই ১৪৪ ধারা মেনে নিতে পারে নি। 

২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে এ সভায় ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে দ্বিমত দেখা দেয়। অধিকাংশ সদস্য প্রথমে ১৪৪ ধারা অমান্য করার পক্ষে ছিলেন না৷ কিন্তু, আবদুল মতিন, ওলি আহাদ, গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতারা ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন। অবশেষে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সভায় ছোট ছোট দলে ছাত্ররা মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়৷ ছাত্র-ছাত্রীরা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' শ্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকলে পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। 

ছাত্রছাত্রীরাও পুলিশের উপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে  বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে সমাবেত হয়ে গণপরিষদের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বার ঘটনাস্থলেই শহীদ হন৷ আব্দুস সালাম ঐদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল শহীদ হন। 

বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভ শুরু হয়। জনতা শহীদদের জন্য শোক মিছিল বের করে। সেখানেও পুলিশ ও মিলিটারি লাঠি, গুলি ও বেয়োনেট ব্যবহার করে। এতে শফিউর রহমানসহ আরও কয়েকজন শহীদ হন। অনেকে গ্রেফতার ও হন। ছাত্ররা যে স্থানে গুলিতে নিহত হয় সেখানে ছাত্ররা সারারাত জেগে ২৩ ফেব্রুয়ারিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদমিনার নির্মাণ করে। পরে পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে দেয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে অস্থায়ী শহীদ মিনারের স্থলে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনায় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী এটা ভেঙে দিলে ১৯৭২ সালে সে নকশা অনুযায়ী বর্তমান শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। 

তারপর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। 

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে 'একুশে ফেব্রুয়ারি'কে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে সারা বিশ্বে আমাদের মাতৃভাষা দিবসকে সবাই "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে পালন করে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। 

পরিশেষে সকল শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আর সবাই মায়ের ভাষায় টান রেখে যেন শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারি- সেই কামনাই করি। 

    লবীব আহমেদ। 
# সাহিত্যিক, ব্লগার ও সাংবাদিক।

1 comment:

  1. গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ধন্যবাদ

    ReplyDelete

Powered by Blogger.